ভারতীয় সংবিধানের বিবর্তন: ঔপনিবেশিক আইন থেকে সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ

 


ভারতীয় সংবিধানের বিবর্তন: ঔপনিবেশিক আইন থেকে সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ

ভূমিকা

ভারতীয় সংবিধান কোনও আকস্মিক রাজনৈতিক ঘটনার ফল নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘ ও জটিল ঐতিহাসিক বিবর্তনের চূড়ান্ত পরিণতি। এর ভিত্তি প্রোথিত রয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় এক শতাব্দীর আইনগত ও রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্যে। ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান এবং ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে সাংবিধানিক কাঠামোর সূচনা হয়েছিল, তা বিভিন্ন আইন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে অবশেষে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা এবং ১৯৫০ সালের প্রজাতন্ত্র ঘোষণার মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। এই বিশ্লেষণটির মূল উদ্দেশ্য হলো ঔপনিবেশিক আমলের প্রধান আইনগুলো থেকে শুরু করে গণপরিষদের গঠন এবং সংবিধান কার্যকর হওয়া পর্যন্ত এই ঐতিহাসিক যাত্রাপথের একটি বিশদ এবং বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা উপস্থাপন করা।

১. ব্রিটিশ রাজত্বের ভিত্তি স্থাপন এবং প্রাথমিক আইন সংস্কার (১৮৫৮-১৯০৯)

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় প্রশাসন ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৮৫৮ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃতি আমূল পরিবর্তিত হয় এবং সরাসরি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্বে প্রণীত কাউন্সিল আইনগুলো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রাথমিক সংস্কারগুলো, যদিও ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের অধীনে ছিল, অনিচ্ছাকৃতভাবে ভারতীয়দের জন্য রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছিল। সীমিত পরিসরে হলেও, বাজেট আলোচনা ও প্রশ্ন করার অধিকার ভারতীয় অভিজাতদের মধ্যে সংসদীয় রীতিনীতির জন্ম দেয় এবং বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করে, যা ভবিষ্যতের সাংবিধানিক সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

ভারত শাসন আইন, ১৮৫৮

এই আইনটি ছিল ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন। এর মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে এবং ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ মহারানীর হাতে অর্পিত হয়। এই আইনের মূল বিধানগুলো ছিল নিম্নরূপ:

  • ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ মহারানীর উপর ন্যস্ত করা হয়।
  • ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে 'ভারত সচিব' (Secretary of State for India) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, যিনি ভারতীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
  • ভারত সচিবকে সহায়তা করার জন্য একটি ১৫ সদস্যের পরিষদ (Council) গঠন করা হয়।

এই আইনের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য ছিল এটি ভারতে একটি কেন্দ্রীভূত এবং দায়বদ্ধ (ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে) প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা পরবর্তী প্রায় ৯০ বছর ধরে কার্যকর ছিল।

ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৬১ ও ১৮৯২

এই দুটি আইন ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের সূচনা করে। যদিও তাদের ক্ষমতা সীমিত ছিল, এই আইন দুটি ভারতীয়দের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল। নিচে আইন দুটির একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ प्रस्तुत করা হলো:

বৈশিষ্ট্য

ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৬১

ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৯২

ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্তি

প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের আইনসভায় 'অসরকারি' (non-official) সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে অসরকারি সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।

নির্বাচন ব্যবস্থা

সদস্যদের মনোনয়নের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হতো; কোনও নির্বাচন ব্যবস্থা ছিল না।

পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার সূচনা করা হয়, যদিও 'নির্বাচন' শব্দটি স্পষ্টভাবে ব্যবহার করা হয়নি।

পরিষদের ক্ষমতা

আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হলেও, বাজেট আলোচনা বা প্রশ্ন করার অধিকার ছিল না।

সদস্যদের বাজেট নিয়ে আলোচনা করার এবং নির্দিষ্ট শর্তে প্রশ্ন করার সীমিত অধিকার দেওয়া হয়।

প্রাদেশিক পরিষদ

বোম্বে (মুম্বাই) এবং মাদ্রাজ (চেন্নাই) প্রেসিডেন্সিতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রাদেশিক পরিষদের ক্ষমতা আরও কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়।

ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৯০৯ (মর্লে-মিন্টো সংস্কার)

লর্ড মর্লে (তৎকালীন ভারত সচিব) এবং লর্ড মিন্টোর (তৎকালীন ভাইসরয়) নামে পরিচিত এই সংস্কার আইনটি পূর্ববর্তী আইনগুলোর তুলনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এই আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের আকার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয় এবং সদস্যদের বাজেট আলোচনা, সম্পূরক প্রশ্ন করা এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রস্তাব আনার অধিকার দেওয়া হয়।

তবে এই আইনের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা (separate electorates) প্রবর্তন। এই ব্যবস্থার অধীনে মুসলিম সদস্যরা শুধুমাত্র মুসলিম ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন। এই পদক্ষেপটি ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বীজ বপন করেছিল। ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে এটি পৃথক রাজনৈতিক পথের জন্ম দেয়, যা সম্প্রদায়গত সহযোগিতাকে নিরুৎসাহিত করে এবং সরাসরি দ্বিজাতি তত্ত্বের যুক্তিকে শক্তিশালী করে তোলে। ফলস্বরূপ, যা ছিল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, তা অবশেষে দেশভাগের এক অনিবার্য রাজনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তি স্থাপন করে।

এই প্রাথমিক সংস্কারগুলো ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা तीव्रতর করে তোলে, যা পরবর্তী দশকে আরও ব্যাপক সাংবিধানিক পরিবর্তনের মঞ্চ প্রস্তুত করে।

২. স্বায়ত্তশাসনের পথে: দ্বৈত শাসন ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপরেখা (১৯১৯-১৯৩৫)

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে প্রণীত আইন দুটি ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোকে এক নতুন পথে চালিত করে। ১৯১৯ এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দুটি শুধুমাত্র শাসনকার্যে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করেনি, বরং একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এই আইনগুলো ছিল ভারতের বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর প্রত্যক্ষ পূর্বসূরি।

ভারত শাসন আইন, ১৯১৯

মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার নামেও পরিচিত এই আইনটি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাদেশিক স্তরে ‘দ্বৈত শাসন’ (Diarchy) ব্যবস্থার প্রবর্তন। এই ব্যবস্থায় প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল – সংরক্ষিত (Reserved) এবং হস্তান্তরিত (Transferred)। গভর্নর তার কার্যনির্বাহী পরিষদের সাহায্যে সংরক্ষিত বিষয়গুলো (যেমন - অর্থ, পুলিশ) পরিচালনা করতেন এবং ভারতীয় মন্ত্রীদের সাহায্যে হস্তান্তরিত বিষয়গুলো (যেমন - শিক্ষা, স্বাস্থ্য) পরিচালনা করতেন, যাঁরা প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন। তবে এই ব্যবস্থাটি কাঠামোগতভাবে ব্যর্থ হওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছিল, কারণ অর্থ এবং আইনশৃঙ্খলা-র মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলো ব্রিটিশদের হাতে সংরক্ষিত থাকায় ভারতীয় মন্ত্রীদের ভূমিকা মূলত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছিল। কেন্দ্রে একটি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা (Bicameral Legislature) প্রতিষ্ঠিত হয়।

দ্বৈত শাসনের অন্তর্নিহিত ব্যর্থতা এবং ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী চাপের মুখে, ব্রিটিশ সরকার একটি আরও ব্যাপক সাংবিধানিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, যার ফলস্বরূপ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণীত হয়।

ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫

এই আইনটি ছিল ব্রিটিশ ভারতে প্রণীত সর্বশেষ এবং সবচেয়ে વિસ્તృత সাংবিধানিক দলিল। এটিকে ভারতের বর্তমান সংবিধানের প্রধান উৎস বা ব্লুপ্রিন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে এর অনেক কিছুই শুধু গৃহীতই হয়নি, বরং সেগুলোর দার্শনিক ধারাবাহিকতাও বজায় রাখা হয়েছে।

  • সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র: এই আইনে ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ এবং দেশীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে একটি 'সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র' (All-India Federation) গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। যদিও দেশীয় রাজ্যগুলোর আপত্তির কারণে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটি বাস্তবে রূপায়িত হয়নি।
  • ক্ষমতা বিভাজন: কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের জন্য তিনটি তালিকা তৈরি করা হয়— কেন্দ্রীয় তালিকা (Central List), প্রাদেশিক তালিকা (Provincial List) এবং যুগ্ম তালিকা (Concurrent List)। এই বিভাজন শুধুমাত্র একটি সুবিধাজনক প্রশাসনিক কাঠামো ছিল না, এটি ছিল ভারতের বিপুল বৈচিত্র্যকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বিত করার একটি অপরিহার্য নীতি, যা গণপরিষদ সরাসরি গ্রহণ করে।
  • যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত: কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোর মধ্যে বা বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে সাংবিধানিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দিল্লিতে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত (Federal Court) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি কেবল ভারতের বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের পূর্বসূরিই ছিল না, এটি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার (judicial review) নীতিটিকেও প্রতিষ্ঠা করেছিল।

তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে জি. এফ. হোর (G. F. Hoare)-এর উক্তিতে, যেখানে তিনি বলেন, "It should be treated as the last political gift of the British Imperialism." এই আইনটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রদান করলেও, ক্ষমতার চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ তখনও ব্রিটিশ সরকারের হাতেই ছিল।

এই আইনগত কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য ভারতীয়দের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হতে থাকে, যা চূড়ান্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনাকে অপরিহার্য করে তোলে।

৩. স্বাধীনতা ও বিভাজনের পথে: চূড়ান্ত রাজনৈতিক আলোচনা (১৯৪২-১৯৪৭)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। যুদ্ধের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করতে বাধ্য হয়। এই পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক প্রস্তাবনা আনা হয়, যা কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক মেরুকরণের সাক্ষী। প্রতিটি ব্যর্থ প্রস্তাবনা দলগুলোর অবস্থানকে আরও কঠোর করে তোলে, যা পরবর্তী সমঝোতাকে আরও কঠিন করে তোলে এবং বিভাজনকে প্রায় অনিবার্য করে তোলে।

ক্রিপস প্রস্তাব (Cripps Proposal), ১৯৪২

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের সহযোগিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে এই মিশন ভারতে আসে। এর মূল প্রস্তাব ছিল যুদ্ধ শেষে ভারতকে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস এবং একটি গণপরিষদ গঠন। কিন্তু প্রদেশগুলোকে ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করে, এবং মুসলিম লীগ পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে অটল থাকায় এটি ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা অবিশ্বাসকে আরও গভীর করে।

ওয়াভেল পরিকল্পনা (Wavell Plan)

ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন, যেখানে ভাইসরয় ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া বাকি সকল সদস্যই ভারতীয় হবেন। কিন্তু কার্যনির্বাহী পরিষদে হিন্দু ও মুসলিম সদস্যদের সংখ্যা নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থার কারণে এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়, যা প্রমাণ করে যে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নিয়ে দুই দলের মধ্যে সমঝোতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা (Cabinet Mission Proposal), ১৯৪৬

ক্ষমতা হস্তান্তরের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা হিসেবে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন একটি অখণ্ড ভারতের মধ্যে একটি দুর্বল কেন্দ্র এবং তিনটি প্রাদেশিক গোষ্ঠী নিয়ে একটি জটিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রস্তাব দেয়। এই পরিকল্পনাটিই ছিল অখণ্ড ভারতকে রক্ষা করার শেষ বাস্তবসম্মত সুযোগ। কিন্তু এর ব্যাখ্যা নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং উভয় পক্ষই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। এই মিশনের ব্যর্থতাই ছিল সেই નિર્ણায়ক মুহূর্ত, যা প্রমাণ করে যে একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতের ধারণা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আর কার্যকর নয়।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭

সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ভারত বিভাজন ছাড়া ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব নয়। তার পরিকল্পনা, যা মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা নামে পরিচিত, ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

এই পরিকল্পনাকে আইনি রূপ দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ (Indian Independence Act, 1947) পাস করে। এই আইন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ব্রিটিশ শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটায় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন ডোমিনিয়ন তৈরি করে।

ক্ষমতা হস্তান্তরের পর, নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র ভারতের জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার গুরুদায়িত্ব গণপরিষদের উপর অর্পিত হয়।

৪. গণপরিষদ: একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংবিধান রচনা (১৯৪৬-১৯৫০)

গণপরিষদ ছিল স্বাধীন ভারতের স্বপ্নকে একটি সাংবিধানিক দলিলে রূপান্তরিত করার ঐতিহাসিক মঞ্চ। এর সদস্যরা শুধুমাত্র একটি দেশের সর্বোচ্চ আইনই রচনা করেননি, বরং একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, এবং অঞ্চলের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই পরিষদ ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রকে ধারণ করে একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী সংবিধান রচনা করতে সক্ষম হয়েছিল।

গণপরিষদের গঠন ও কার্যপ্রণালী

গণপরিষদের গঠন ও কার্যকলাপের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলো ছিল নিম্নরূপ:

  • গঠন: ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার অধীনে গণপরিষদ গঠিত হয়। এর প্রাথমিক সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৮৯, যাঁরা প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুসলিম লীগের সদস্যরা যোগ না দেওয়ায় প্রাথমিক কার্যক্রমে সদস্য সংখ্যা কমে আসে।
  • প্রথম অধিবেশন: ১৯৪৬ সালের ৯ই ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ডঃ সচ্চিদানন্দ সিনহাকে পরিষদের অস্থায়ী সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
  • স্থায়ী সভাপতি: ১৯৪৬ সালের ১১ই ডিসেম্বর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের স্থায়ী সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
  • উদ্দেশ্যমূলক প্রস্তাব (Objectives Resolution): ১৯৪৬ সালের ১৩ই ডিসেম্বর জওহরলাল নেহরু পরিষদে একটি 'উদ্দেশ্যমূলক প্রস্তাব' উত্থাপন করেন, যা সংবিধানের দর্শন ও মূলনীতির রূপরেখা প্রদান করে এবং পরবর্তীকালে সংবিধানের প্রস্তাবনার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
  • খসড়া কমিটি (Drafting Committee): ১৯৪৭ সালের ২৯শে আগস্ট সংবিধানের খসড়া তৈরির জন্য একটি খসড়া কমিটি গঠন করা হয়। আইন বিশেষজ্ঞ ডঃ বি. আর. আম্বেদকরকে এই কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করা হয়, যিনি সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে প্রধান স্থপতির ভূমিকা পালন করেন।

সংবিধান গ্রহণ ও কার্যকর

অগণিত বিতর্ক, আলোচনা এবং সংশোধনের পর গণপরিষদ তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পন্ন করে।

  • ভারতীয় সংবিধান রচনা করতে মোট সময় লেগেছিল ২ বছর, ১১ মাস, ১৮ দিন
  • সংবিধান রচনার কাজ শেষ হলে, ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর তারিখে গণপরিষদ কর্তৃক এটি গৃহীত হয়। এই দিনটি বর্তমানে ভারতে 'সংবিধান দিবস' হিসেবে পালিত হয়।
  • অবশেষে, ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী তারিখে ভারতীয় সংবিধান সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হয়। এই দিনটিকে বেছে নেওয়ার কারণ হলো, ১৯৩০ সালের এই দিনেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের ডাক দিয়েছিল। এই দিন থেকে ভারত একটি ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের পরিবর্তে একটি "সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র" (Sovereign Democratic Republic) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

এইভাবেই গণপরিষদ ভারতের জনগণকে এমন একটি সংবিধান উপহার দেয় যা দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণ করে এবং একটি নতুন প্রজাতন্ত্রের জন্ম দেয়।

৫. উপসংহার

ভারতীয় সংবিধানের বিবর্তন একটি দীর্ঘ এবং শিক্ষণীয় যাত্রার ইতিহাস। এটি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে প্রবর্তিত আইনগুলোর কাঠামো থেকে শুরু হয়ে, স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, এবং অবশেষে গণপরিষদের সদস্যদের জ্ঞান ও দূরদৃষ্টির মাধ্যমে একটি সার্বভৌম দলিলে পরিণত হয়েছে। ১৮৫৮ সালের নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন থেকে শুরু করে ১৯৩৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপরেখা, এবং পরিশেষে গণপরিষদ কর্তৃক একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা—এই প্রতিটি ধাপই একে অপরের সাথে ঐতিহাসিকভাবে সংযুক্ত। ভারতীয় সংবিধান তাই শুধুমাত্র একটি আইনগ্রন্থ নয়, এটি একটি জাতির ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম এবং বহুত্ববাদী আদর্শের জীবন্ত প্রতীক, যা ঔপনিবেশিক অতীত থেকে একটি সার্বভৌম ভবিষ্যতের দিকে উত্তরণের সাক্ষ্য বহন করে।

No comments:

Post a Comment