বুদ্ধদেব কোন দার্শনিক আলোচনা করেন নি। কিন্তু বুদ্ধদেবের উপদেশের ভিত্তিতে বৌদ্ধদর্শন গড়ে উঠেছে। তিনি মুখে মুখে উপদেশ দিতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যগণ তাঁর বাণীগুলিকে পালিভাষায় লিখে তিনটি গ্রন্থে সংকলিত করেন। এই তিনটি গ্রন্থকে একত্রে ‘ত্রিপিটক’ বলা হয়। পিটক মানে পেটি বা ঝাঁপি। এগুলি হল—– বিনয়পিটক, সুত্তপিটক ও অভিধম্মপিটক। বিনয়পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আচরণ-সংক্রান্ত নিয়মাবলীর কথা বলা হয়েছে। সুত্তপিটকে ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে বুদ্ধদেবের নানা উপদেশ লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর আবার পাঁচটি নিকায় বা বিভাগ আছে। অভিধম্মপিটকে সুত্তপিটকের সূত্র বা সংক্ষিপ্ত বচনগুলির বিস্তৃত আলোচনা ও দার্শনিক আলোচনা লিপিবদ্ধ আছে। ত্রিপিটক ছাড়া থেরগাথা, জাতক, ধৰ্ম্মপদ, মিলিন্দপঞহো, দীপবংশ, মহাবংশ প্রভৃতি বিখ্যাত বৌদ্ধগ্রন্থ।
১। চত্বারি আর্থসভ্যানি (The four noble truths) : বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের মূল কথা নিহিত আছে চারটি আর্যসত্যে। এগুলি হল—–(3) দুঃখ,
(২) দুঃখসমুদয় (৩) দুঃখনিরোধ এবং (৪) দুঃখনিরোধ-মার্গ। (১) দুঃখ-বুদ্ধদেবের মতে জগৎ ও জীবন দুঃখময় ('সর্বং দুঃখম্')। জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি
ইত্যাদি এবং পঞ্চোপাদান-সদ্ধময় দেহ ও মনও দুঃখময়।
(২) দুঃখসমুদয়-দুঃখ যখন আছে তখন দুঃখের কারণও আছে। কারণ ছাড়া কার্য হতে পারে না। কারণশৃঙ্খল মানতেই হয়। দুঃখের কারণশৃঙ্খলই দুঃখসমুদয়। এই বৌদ্ধমতে প্রতীত্যসমুৎপাদপাদনীতির উপর দুঃখসমূদর প্রতিষ্ঠিত। কারণ থেকে কার্যের শৃঙ্খলটি এরূপ অবিদ্যা > সংস্কার (শুভাশুভ কর্মে প্রবণতা) > বিজ্ঞান (মাতৃগর্ভে প্রাথমিক চেতনা) > নাম রূপ (দেহ-মন) > ষড়ায়তন (ছটি ইন্দ্রিয়) > স্পর্শ (বিষয়-ইন্দ্রিয় সংযোগ) > বেদনা ( সুখ দুঃখের অনুভূতি) > তৃষ্ণা > উপাদান (আসক্তি) >ভব (জন্মলাভের আকাঙ্ক্ষা) > জাতি (জন্ম) > দুঃখ। এই বারটিকে বলে স্বাদর্শনিদান বা ভবচক্র।
(৩) দুঃখনিরোধ নামক তৃতীয় আর্যসত্যের মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব। যার উৎপত্তি আছে, তারই বিনাশ আছে। দুঃখের আত্যন্তিক বা নিরবশেষ নিবৃত্তিই নির্বাণ। (৪) চতুর্থ আর্যসত্য হল দুঃখনিরোধমার্গ অর্থাৎ দুঃখনিবৃত্তির উপায়সমূহ। এর আটটি অঙ্গ আছে। সেগুলি হল—সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।
২। অষ্টাঙ্গিক মার্গ (Eightfold path) :
প্রবৃত্তির কারাগারে আবদ্ধ জীবের দুঃখ নিরোধ-মার্গ রূপ চতুর্থ আর্যসত্যে বুদ্ধদেব অষ্টাঙ্গিক
মার্গের উপদেশ দিয়েছেন। নিচে সেগুলির আলোচনা করা হল : (১) সম্যক দৃষ্টি ধম্মপদে বলা হয়েছে যে, মিথ্যা দৃষ্টির প্রভাবে জীব অসারকে সার এবং সারকে অসার মনে করে ভ্রমে পতিত হয় এবং এই ভ্রমই হল সংসারের নিদান। তা দূর করতে চারটি আর্যসত্য সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান দরকার। এই জ্ঞানই সম্যক দৃষ্টি।
(২) সম্যক সল্প সম্যক দৃষ্টির বা যথার্থ জ্ঞানের পাশাপাশি সম্যক সঙ্কল্প অর্থাৎ আসক্তি বর্জন, পরছেষ-বর্জন ও পরের অনিষ্ট না করার সঙ্কল্প গ্রহণ করবার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। সঙ্কল্প বা দৃঢ় প্রত্যয় ছাড়া কোন মহৎ কার্য সম্পন্ন হয় না।
(৩) সম্যক বাক—সঙ্কলকে কার্যে পরিণত করতে চাই সম্যক বাক বা ন্যায়সম্মত বাক্য তথা বানিয়ন্ত্রণ। মিথ্যাভাষণ, পরনিন্দা, কর্কশবাক্য ও লঘু আলাপ বর্জনই সম্যক বাক।
(৪) সম্যক কর্মান্ত—সম্যক সঙ্কল্পকে কার্যে পরিণত করতে সম্যক বাক ছাড়া সম্যক কর্মান্ত অর্থাৎ ন্যায়সঙ্গত আচরণও প্রয়োজন। অহিংসা, অন্তেয় (চুরি না করা), ব্রহ্মচর্য, সত্যপালন ও মাদকবর্জন—এই পঞ্চশীলই বুদ্ধদেবের মতে সম্যক কর্মান্ত।
(৫) সম্যক আজীব— বাসনাশূন্য হৃদয়ে পঞ্চশীলকে লঙ্ঘন না করে সাধু উপায়ে জীবিকা অর্জনই সমাক আজীব। জীবন রক্ষার জন্যও অসৎ উপায় অবলম্বন করা উচিত নয়।
(৬) সম্যক ব্যায়াম—বাধক শক্তির সঙ্গে সাধক শক্তির নিরন্তর সংগ্রামে জয়ী হতে চাই সম্যক ব্যায়াম অর্থাৎ সং চিন্তা। অসৎ চিন্তা দূর করা ও তার উদয় রোধ করা এবং সর্বদা সৎ চিন্তায় মনকে পরিপূর্ণ করে রাখাই সম্যক ব্যায়াম।
(৭) সম্যক স্মৃতি – দেহ ও সমগ্র জগতের অনিত্যতার কথা সর্বদা স্মরণে রেখে সম্যক দৃষ্টির বা যথার্থ জ্ঞানের প্রদীপটিকে সর্বদা জ্বালিয়ে রাখাই সম্যক স্মৃতি। এতে নির্বাণলাভ ত্বরান্বিত হয়।
(৮) সম্যক সমাধি-পূর্ববর্ণিত সাতটি মার্গের যথাযথ অনুসরণকারী সত্যকাম ব্যক্তি নিরন্তর প্রস্তাভাবনায় সম্যক সমাধিরূপ অন্তিম মার্গে উপস্থিত হন। সমাধি বা ধ্যানের চারটি স্তর আছে। শেষ স্তবে দুঃখে সুখে ঔদাসীন্য জাগে, দুঃখের নিবৃত্তি ঘটে এবং তৃতীয় স্তরে অনুভূত স্বস্তির বোধও চলে যায়। একেই নির্বাণ বলা হয়।
৩। প্রতীত্যসমুৎপাদ (Pratityasamutpada) :
প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ বৌদ্ধদর্শনের একটি মৌলিক তত্ত্ব। বুদ্ধদেব সাধারণতঃ দার্শনিক আলোচনা এড়িয়ে চললেও চারটি আর্থসত্যের তথা তার নৈতিক উপদেশের ভিত্তিরূপে এই তত্ত্ব প্রণয়ন করেছেন। তিনি এই তত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে একে ধৰ্ম্ম (ধর্ম) বলেছেন। বৌদ্ধ দর্শনের কর্মবাদ, অনিত্যবাদ, নৈরাত্ম্যবাদ, নিরীশ্বরবাদ ও শূন্যবাদ—এই নীতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত। এটি বৌদ্ধ কার্যকারণতত্ত্ব এবং চার্বাক যদৃচ্ছ্যবাদের বিরোধী। 'প্রতীত্য' মানে 'পেয়ে' এবং 'সমুৎপাদ' মানে উদ্ভব। সুতরাং কথাটির অর্থ—কোন কিছু পেয়ে বা অবলম্বন করে কোন কিছুর উৎপত্তি। আকস্মিকভাবে কোন কিছু ঘটতে পারে না। অস্তিত্ব যার আছে তার কোন কারণ অবশ্যই আছে। এই মতবাদ অনুসারে শর্তনিরপেক্ষ কোন চিরন্তন সত্তা বা নিত্যবত্ত নেই। সব কিছুই শর্তাধীন; কার্যকারণের এক শৃঙ্খলা বা মহতী পরম্পরা বা ধারাবাহিকতা ঘটেই চলেছে। কারণের আবির্ভাবে কার্যের আবির্ভাব এবং কারণের তিরোভাবে কার্যের তিরোভাব ঘটে। তবে প্রতিটি পদার্থ তার বিনাশের পূর্বে একটা কিছু রেখে যায় যা থেকে অপর বস্তুর উদ্ভব ঘটে। তাই কোন বস্তুর আত্যন্তিক বিনাশও নেই। এই নীতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে চলেছে। এবং তাই এরজন্য ঈশ্বর স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই। ন্যায়দর্শনেও কার্যকে শর্তাধীন বলে স্বীকার করা হয়েছে। তবে সেখানে ঈশ্বরের কর্তৃত্বের কথা আছে। এখানেই উভয়ের পার্থক্য। সুতরাং প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ নিরীশ্বরবাদের, অনিত্যবাদের (জগতের সব কিছুই অনিত্য) এবং তা থেকে উদ্ভূত ক্ষণিকবাদের (সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী) ভিত্তি। সব কিছুই অনিত্য হলে নিত্য বা স্থায়ী আত্মা বলে কিছু থাকতে পারে না। সুতরাং এই নীতি নৈরাত্ম্যবাদেরও ভিত্তি। এগুলি হল এই মতবাদের তাত্ত্বিক দিক। এর একটি নৈতিক দিকও আছে। দুঃখও একটি কার্য (উৎপন্ন পদার্থ)। সুতরাং এই নীতি অনুসারে দুঃখেরও কারণ আছে এবং তাও কার্য-কারণ শৃঙ্খলের অধীন। কারণের নাশে কার্যেরও বিনাশ ঘটবে। দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যা এবং তার নাশে দুঃখ নিরোধ ঘটবে। এইভাবে এই তত্ত্ব দুঃখসমূদয় ও দুঃখনিরোধ—এই দুটি আর্থসত্যের ভিত্তি।
আবার এই তত্ত্বই কর্মফলবাদেরও ভিত্তি। কারণ ফলের সঙ্গে কর্মের কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। জন্মান্তরবাদ আবার কর্মফলবাদের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং আলোচ্য মতবাদটি তারও ভিত্তি। এই তত্ত্বের মাধ্যমেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের পারস্পরিক অন্বয় ও আপেক্ষিকতা প্রদর্শিত হয়েছে। অবশ্য এই তত্ত্বটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কারণ, এই তত্ত্বে সব কিছুই পূর্ববর্তী ঘটনার উপর নির্ভরশীল বলা হয়েছে। অথচ বুদ্ধদের দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যার কোন পূর্ববর্তী কারণ বা শর্তের কথা বলেন নি।
No comments:
Post a Comment